নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে প্রস্তুত নয় এনবিআর
ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারেনি।এদিকে নতুন ভ্যাট আইন চালুর ছয় মাস পার হয়ে গেছে। নতুন আইনটি অনলাইনবেইজ হলেও এর মূল কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। পুরোনো পদ্ধতিতেই কাগুজে ভ্যাট রিটার্ন দিতে হচ্ছে। অনলাইনে ভ্যাটের টাকাও পরিশোধ করা যায় না।
তিন দিনে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ আগাম কর ফেরত পাওয়ার কোনো কৌশল ঠিক হয়নি। আইন চালুর পর মাঠপর্যায়েও ভ্যাট আদায়ে নানা সমস্যা হচ্ছে। এর ফলে নতুন আইনের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না।
ভ্যাট আইনের এসব জটিলতার কারণে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি ৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এ খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। চার মাসে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের কিছুটা বেশি। চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য আছে।
২০১২ সালের ভ্যাট আইনটি প্রস্তুতির জন্য পাঁচ বছর সময় নেয় এনবিআর। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে চালুর কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে দুই বছর পিছিয়ে দিয়ে দাবি অনুযায়ী একাধিক ভ্যাট হার বহাল রেখে গত জুলাই মাসে আইনটি চালু করা হয়। কিন্তু সাত বছর সময় পেলেও ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পুরো প্রস্তুতি নিতে পারেনি এনবিআর।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সময় টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়নে এনবিআরের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কাঠামোগত দুর্বলতা এড়িয়ে নতুন আইনের সুফল পেতে যে ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার দরকার ছিল, তা এনবিআর করতে পারেনি। মাঠপর্যায় থেকে নানা ধরনের বাধা এসেছে। এত দিন ধরে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা পুরোনো আইনে যেসব অনৈতিক সুবিধা পেতেন, তাঁরাই সংস্কারে বাধা দিচ্ছেন। তিনি মনে করেন, নতুন আইন বাস্তবায়নের ১৫ দিন আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করা হয়। এতে আসলে পুরোনো আইনের রেপ্লিকাই বাস্তবায়িত হয়েছে।
প্রস্তুতি শেষ হয়নি
ভ্যাট আইনের কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালনার জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১৩ সালে ৬৯০ কোটি টাকার ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অনলাইন নিবন্ধন, ভ্যাট রিটার্ন জমা, ভ্যাট পরিশোধ—এসব ঘরে বসেই সম্পন্ন করার কথা।
ছয় বছরে শুধু অনলাইন নিবন্ধন চালু করা সম্ভব হয়েছে। তা–ও ঠিকমতো কাজ করছে না বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। ভ্যাট অনলাইনের সার্ভার প্রায়ই ডাউন থাকে, অনেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইবিআইএন পাচ্ছেন না। ই–মেইলে ইবিআইএন সনদ পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু ই–মেইল না পাওয়ায় আবেদনকারীদের অনেকেরই ভ্যাটের সার্কেল কার্যালয়ে ধরনা দিতে হয়েছে।
ভ্যাট রিটার্নও অনলাইনে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। গত মাসে সনাতনি পদ্ধতিতে ১ লাখ ৫ হাজার ভ্যাট রিটার্ন জমা পড়েছে। এদিকে ভ্যাট পরিশোধের জন্য এখনো ই-পেমেন্ট চালু করতে পারেনি এনবিআর।
ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে কেনা দামে ব্যবসায়ীদের ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা অনেকটা ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) মেশিনের মতো। গত জানুয়ারি মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়। একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে গত জুলাই মাসে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার ইএফডি মেশিন আমদানির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানকে তিন মাস সময় দেওয়া হলেও এখনো তা দেশে পৌঁছায়নি।
ইএফডি মেশিনের সব তথ্য ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষিত থাকবে। সেই তথ্য সংরক্ষণের জন্য সার্ভারের যন্ত্রপাতি দুই সপ্তাহ আগে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। এসব যন্ত্রপাতি সংযোজন করে সার্ভার প্রস্তুত হলে উড়োজাহাজে ইএফডি মেশিন দেশে আসবে বলে জানা গেছে।
বছরে ৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়—এমন প্রতিষ্ঠানকে এনবিআর নির্দেশিত বিশেষ সফটওয়্যারে হিসাবনিকাশ সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য সফটওয়্যার সরবরাহে এনবিআর এই পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করেছে। এনবিআর চায়, সফটওয়্যারটি সহজলভ্য করতে আরও সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান এই তালিকায় আসুক। কিন্তু আগ্রহী প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহীদের আবেদনের এই সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট নীতি) আবদুল মান্নান শিকদার সময় টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘ভ্যাট অনলাইনের কাজগুলো একবারে করা সম্ভব নয়। এটি ধাপে ধাপে করতে হবে। ইতিমধ্যে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন ও ভ্যাট রিটার্ন জমার কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো যাতে সঠিকভাবে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-পেমেন্ট সংক্রান্ত অনুমোদন পাওয়া গেলে আমরা অনলাইনে ভ্যাট পরিশোধের কাজও শুরু করে দেব।’ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অনলাইনে ভ্যাট কার্যক্রম আরও দৃশ্যমান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
নতুন আইনে মাঠপর্যায়ে ভ্যাট নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। যেমন আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) উঠিয়ে ৫ শতাংশ আগাম কর বসানো হয়েছে, যা সমন্বয় করা যাবে। কিন্তু কীভাবে রেয়াতের টাকা ব্যবসায়ীদের ফেরত দেওয়া হবে, তা–ও পরিষ্কার নয়। গত ছয় মাসে রেয়াতের টাকা ফেরতের কৌশল ঠিক করতে পারেনি এনবিআর। কৌশল ঠিক করতে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সব কমিশনারের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। কৌশল ঠিক করতে আরও কয়েক মাস লাগবে।
বড় আমদানিকারকদের একেকটি চালানে আমদানি পর্যায়ে কয়েক কোটি টাকা আগাম কর দিতে হচ্ছে। ভ্যাটের রেয়াতের টাকা ফেরতের পদ্ধতি না থাকায় অনেক ব্যবসায়ীর টাকা আটকে আছে।
বিজ্ঞাপনের বিল সংগ্রহের ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনে সংবাদপত্রের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আছে। এই ভ্যাট বিজ্ঞাপনের বিলের ওপর বসে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ১০০ টাকার বিজ্ঞাপন দেয়, তবে ওই প্রতিষ্ঠানকে ১১৫ টাকা পরিশোধ করতে হবে। অন্য কোনো পণ্য বা সেবায় ১৫ শতাংশের কম ভ্যাট হার হলে সেবা বা পণ্যগ্রহীতা বিল দেওয়ার সময় ওই টাকা কেটে রেখে বিল পরিশোধ করবেন। বিক্রেতা বা সরবরাহকারীকে ৬ দশমিক ৬ বা উৎসে কর কর্তন সনদ দেবে।
বিজ্ঞাপনের ওপর ভ্যাটের হার একটিই, ১৫ শতাংশ। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপনের বিলের সঙ্গে মূসক ফরম ৬ দশমিক ৩ দিলেও মাঠপর্যায়ের ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রমাণ হিসেবে ট্রেজারি চালান চান। নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী, বিলের সঙ্গে ৬ দশমিক ৩ ফরম বা কর চালানপত্র দিলেই ক্রেতার জন্য দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের পক্ষে আলাদাভাবে ট্রেজারি চালানের দলিল দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ যখন ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়, তখন কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কত টাকার বিজ্ঞাপন নেওয়া হয়েছে, ভ্যাট বাবদ সরকারি কোষাগারে কত টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, তা একই দলিলে সব তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। ফলে আলাদা করে প্রতিটি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানকে ট্রেজারি চালান দেওয়া সম্ভব হয় না।
নতুন ভ্যাট আইনে ইলেকট্রনিক সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। কিন্তু কীভাবে এই ভ্যাট আদায় করা হবে, তা নিয়ে জটিলতা আছে। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের পেজে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বর্তমানে এনবিআরের সফটওয়্যার থেকে দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এসব অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাটের ব্যবসায় নিবন্ধন (ইবিআইএন) নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই সমস্যার সমাধানে এনবিআর ভ্যাট এজেন্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কথা বলেছে।
এ ছাড়া পাইকারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের হিসাবনিকাশ সংরক্ষণ নিয়ে আপত্তি আছে। এতে খরচ বাড়বে বলে দাবি করছেন তাঁরা। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা সময় টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘ভ্যাটের হিসাবনিকাশ করতে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের অন্তত দু–তিনজন হিসাবরক্ষক রাখতে হবে। আমরা যাদের কাছ থেকে মাল কিনি কিংবা যাদের কাছে বিক্রি করি, তাদের কেউ ভ্যাটের রসিদ দিতে পারে না। ফলে ভ্যাট রেয়াত নেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া অনেকেই এখনো ইবিআইএন নেয়নি। এর ফলে বহু ব্যবসায়ী ভ্যাট দিতে পারেননি। তবে ভ্যাট কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে ইবিআইএনের ফরম দিয়ে গেছেন।’
তিন দিনে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ আগাম কর ফেরত পাওয়ার কোনো কৌশল ঠিক হয়নি। আইন চালুর পর মাঠপর্যায়েও ভ্যাট আদায়ে নানা সমস্যা হচ্ছে। এর ফলে নতুন আইনের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না।
ভ্যাট আইনের এসব জটিলতার কারণে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি ৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এ খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। চার মাসে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের কিছুটা বেশি। চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য আছে।
২০১২ সালের ভ্যাট আইনটি প্রস্তুতির জন্য পাঁচ বছর সময় নেয় এনবিআর। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে চালুর কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে দুই বছর পিছিয়ে দিয়ে দাবি অনুযায়ী একাধিক ভ্যাট হার বহাল রেখে গত জুলাই মাসে আইনটি চালু করা হয়। কিন্তু সাত বছর সময় পেলেও ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পুরো প্রস্তুতি নিতে পারেনি এনবিআর।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সময় টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়নে এনবিআরের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কাঠামোগত দুর্বলতা এড়িয়ে নতুন আইনের সুফল পেতে যে ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার দরকার ছিল, তা এনবিআর করতে পারেনি। মাঠপর্যায় থেকে নানা ধরনের বাধা এসেছে। এত দিন ধরে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা পুরোনো আইনে যেসব অনৈতিক সুবিধা পেতেন, তাঁরাই সংস্কারে বাধা দিচ্ছেন। তিনি মনে করেন, নতুন আইন বাস্তবায়নের ১৫ দিন আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করা হয়। এতে আসলে পুরোনো আইনের রেপ্লিকাই বাস্তবায়িত হয়েছে।
প্রস্তুতি শেষ হয়নি
ভ্যাট আইনের কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালনার জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১৩ সালে ৬৯০ কোটি টাকার ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অনলাইন নিবন্ধন, ভ্যাট রিটার্ন জমা, ভ্যাট পরিশোধ—এসব ঘরে বসেই সম্পন্ন করার কথা।
ছয় বছরে শুধু অনলাইন নিবন্ধন চালু করা সম্ভব হয়েছে। তা–ও ঠিকমতো কাজ করছে না বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। ভ্যাট অনলাইনের সার্ভার প্রায়ই ডাউন থাকে, অনেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইবিআইএন পাচ্ছেন না। ই–মেইলে ইবিআইএন সনদ পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু ই–মেইল না পাওয়ায় আবেদনকারীদের অনেকেরই ভ্যাটের সার্কেল কার্যালয়ে ধরনা দিতে হয়েছে।
ভ্যাট রিটার্নও অনলাইনে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। গত মাসে সনাতনি পদ্ধতিতে ১ লাখ ৫ হাজার ভ্যাট রিটার্ন জমা পড়েছে। এদিকে ভ্যাট পরিশোধের জন্য এখনো ই-পেমেন্ট চালু করতে পারেনি এনবিআর।
ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে কেনা দামে ব্যবসায়ীদের ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা অনেকটা ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) মেশিনের মতো। গত জানুয়ারি মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়। একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে গত জুলাই মাসে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার ইএফডি মেশিন আমদানির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানকে তিন মাস সময় দেওয়া হলেও এখনো তা দেশে পৌঁছায়নি।
ইএফডি মেশিনের সব তথ্য ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষিত থাকবে। সেই তথ্য সংরক্ষণের জন্য সার্ভারের যন্ত্রপাতি দুই সপ্তাহ আগে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। এসব যন্ত্রপাতি সংযোজন করে সার্ভার প্রস্তুত হলে উড়োজাহাজে ইএফডি মেশিন দেশে আসবে বলে জানা গেছে।
বছরে ৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়—এমন প্রতিষ্ঠানকে এনবিআর নির্দেশিত বিশেষ সফটওয়্যারে হিসাবনিকাশ সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য সফটওয়্যার সরবরাহে এনবিআর এই পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করেছে। এনবিআর চায়, সফটওয়্যারটি সহজলভ্য করতে আরও সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান এই তালিকায় আসুক। কিন্তু আগ্রহী প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহীদের আবেদনের এই সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট নীতি) আবদুল মান্নান শিকদার সময় টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘ভ্যাট অনলাইনের কাজগুলো একবারে করা সম্ভব নয়। এটি ধাপে ধাপে করতে হবে। ইতিমধ্যে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন ও ভ্যাট রিটার্ন জমার কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো যাতে সঠিকভাবে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-পেমেন্ট সংক্রান্ত অনুমোদন পাওয়া গেলে আমরা অনলাইনে ভ্যাট পরিশোধের কাজও শুরু করে দেব।’ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অনলাইনে ভ্যাট কার্যক্রম আরও দৃশ্যমান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
নতুন আইনে মাঠপর্যায়ে ভ্যাট নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। যেমন আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) উঠিয়ে ৫ শতাংশ আগাম কর বসানো হয়েছে, যা সমন্বয় করা যাবে। কিন্তু কীভাবে রেয়াতের টাকা ব্যবসায়ীদের ফেরত দেওয়া হবে, তা–ও পরিষ্কার নয়। গত ছয় মাসে রেয়াতের টাকা ফেরতের কৌশল ঠিক করতে পারেনি এনবিআর। কৌশল ঠিক করতে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সব কমিশনারের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। কৌশল ঠিক করতে আরও কয়েক মাস লাগবে।
বড় আমদানিকারকদের একেকটি চালানে আমদানি পর্যায়ে কয়েক কোটি টাকা আগাম কর দিতে হচ্ছে। ভ্যাটের রেয়াতের টাকা ফেরতের পদ্ধতি না থাকায় অনেক ব্যবসায়ীর টাকা আটকে আছে।
বিজ্ঞাপনের বিল সংগ্রহের ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনে সংবাদপত্রের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আছে। এই ভ্যাট বিজ্ঞাপনের বিলের ওপর বসে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ১০০ টাকার বিজ্ঞাপন দেয়, তবে ওই প্রতিষ্ঠানকে ১১৫ টাকা পরিশোধ করতে হবে। অন্য কোনো পণ্য বা সেবায় ১৫ শতাংশের কম ভ্যাট হার হলে সেবা বা পণ্যগ্রহীতা বিল দেওয়ার সময় ওই টাকা কেটে রেখে বিল পরিশোধ করবেন। বিক্রেতা বা সরবরাহকারীকে ৬ দশমিক ৬ বা উৎসে কর কর্তন সনদ দেবে।
বিজ্ঞাপনের ওপর ভ্যাটের হার একটিই, ১৫ শতাংশ। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপনের বিলের সঙ্গে মূসক ফরম ৬ দশমিক ৩ দিলেও মাঠপর্যায়ের ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রমাণ হিসেবে ট্রেজারি চালান চান। নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী, বিলের সঙ্গে ৬ দশমিক ৩ ফরম বা কর চালানপত্র দিলেই ক্রেতার জন্য দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের পক্ষে আলাদাভাবে ট্রেজারি চালানের দলিল দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ যখন ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়, তখন কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কত টাকার বিজ্ঞাপন নেওয়া হয়েছে, ভ্যাট বাবদ সরকারি কোষাগারে কত টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, তা একই দলিলে সব তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। ফলে আলাদা করে প্রতিটি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানকে ট্রেজারি চালান দেওয়া সম্ভব হয় না।
নতুন ভ্যাট আইনে ইলেকট্রনিক সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। কিন্তু কীভাবে এই ভ্যাট আদায় করা হবে, তা নিয়ে জটিলতা আছে। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের পেজে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বর্তমানে এনবিআরের সফটওয়্যার থেকে দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এসব অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাটের ব্যবসায় নিবন্ধন (ইবিআইএন) নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই সমস্যার সমাধানে এনবিআর ভ্যাট এজেন্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কথা বলেছে।
এ ছাড়া পাইকারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের হিসাবনিকাশ সংরক্ষণ নিয়ে আপত্তি আছে। এতে খরচ বাড়বে বলে দাবি করছেন তাঁরা। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা সময় টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘ভ্যাটের হিসাবনিকাশ করতে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের অন্তত দু–তিনজন হিসাবরক্ষক রাখতে হবে। আমরা যাদের কাছ থেকে মাল কিনি কিংবা যাদের কাছে বিক্রি করি, তাদের কেউ ভ্যাটের রসিদ দিতে পারে না। ফলে ভ্যাট রেয়াত নেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া অনেকেই এখনো ইবিআইএন নেয়নি। এর ফলে বহু ব্যবসায়ী ভ্যাট দিতে পারেননি। তবে ভ্যাট কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে ইবিআইএনের ফরম দিয়ে গেছেন।’