ভারত ভ্রমণঃ পর্ব ০২
ভারত ভ্রমণঃ পর্ব ০২
#মাত্র_৪০৭৫_রূপীতে_সিমলা_মানালী
ফেয়ারলী প্লেস, কলকাতা..
বাইরে বেশ ঠান্ডা। দর্জিলিং (জলপাইগুড়ি) যাওয়ার টিকিট করার জন্য হোটেল থেকে খুব ভোরে এখানে এসে হাজির। এসে দেখি ইতোমধ্যে আমার মত অনেক মানুষই ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য হাজির। অফিস খুলবে সকাল ১০ টায়, তাই এখন নিরাপত্তা প্রহরী সবাইকে সিরিয়াল নাম্বার দিচ্ছে।
সকাল ১০ টা পার হয়ে ১১ টা বাজে কিন্তু কাউন্টার ওপেন হয় না। অবশেষে সাড়ে এগারটার দিকে বিশাল লাইনের প্রথমজনের ডাক পড়লো। ক্রমান্বয়ে লাইনের লোক কমছে। আমার সিরিয়াল ১৩ নাম্বর। অপেক্ষায় .. হুট করে একজন এসে জানতে চাইলো আমি কোথায় যাব? আমারটা শুনে সেও বললো দিল্লী যাবে। এককথায় দু'কথায় জানলাম তার বাড়ি যশোরের শার্শায়। চিকিৎসাগত কারণে দিল্লী যাবে। কিন্তু তার সিরিয়াল ৪৬!! সে একই সাথে সাথে মানালীও ঘুরবে। তার কথায় বেশ প্রলুব্ধ হলাম। সম্পূর্ণ প্লান চেন্জ করে দার্জিলিং, গ্যাংটকের পরিবর্তে দিল্লী, মানালী করলাম। এবার আমার টিকিটের সাথে তার টিকিটও কেটে ফেললাম। তার সৌভাগ্যই বলতে হবে, ঐ দিন রাতের ট্রেনে মাত্র ২ টি নন এসি স্লিপার ছিলো। একটা আমার, একটা তার....
অবশেষে রাত ৯ টা ৫০ মিনিটে শুরু হলো আমাদের কালকা মেইলের জার্নি। হাওড়া স্টেশন থেকে হরিয়ানা রাজ্যের কালকা নামক যায়গা পর্যন্ত এ ট্রেনটি যাবে। মোট ১৮০০+ কিঃমিঃ পার হয়ে পরবর্তী দিবাগত রাত ৪ টায় পৌঁছানোর কথা....
মনের আনন্দে জার্নি শুরু...
দিল্লী যাব
মানালী যাব...
সবচেয়ে বড় কথা, আমি একা না। সাথে একজন আছে যে বেশ এ্যাকটিভ। এর মধ্যে সেও বেশ আছে। ব্যাগ আমার দায়িত্বে রেখে রিল্যাক্সে ঘুরাঘুরি করছে। আর আমি নতুন মানুষ নিজের ব্যাগ, তার ব্যাগ পাহারা দিয়ে রাখছি।
দিল্লী স্টেশন পৌঁছাতে আর ত্রিশ মিনিট মত বাকি। আমি তো পুরাই এক্সাইটেড। ইতোমধ্যে তার সাথে প্লান করে সব ঠিক করেছি, রাতে নেমেই মানালীর বাস ধরবো। কেননা অত রাতে হোটেল খোঁজাটা টাফ!! এমন মুহুর্তে সে আমায় জানিয়ে দিলো, দিল্লী নেমে যাবে সে। মানালী যাবে না। এমনকি ঘোরাঘুরিও করবে না। জাষ্ট ডাক্তার দেখাবে। তার পরিবার থেকে নাকি হুট করে অমন নির্দেশনা....
আমি পুরাই কট!! নতুন জায়গা, কারোর ওপর ভরসা করে এতদূর আসলাম। নতুবা তে সেই দার্জিলিং যেতাম।
মেজাজটা যতটা খারাপ হচ্ছিল, তারচেয়ে বেশি ভয়।
কী হবে? কী করবো?
একা একা কিভাবে এ জার্নি চালাবো!!
হুট করেই ডিসিশন নিলাম "সফর আমি করবোই, এবং শুধু করবোই না,,ভালভাবেই করবো"।
খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এ ট্রেন যেখানে লাস্ট থামবে সেখান থেকে সিমলা যাওয়া যায়। ইতোমধ্যে গুগল করে সিমলা, টয় ট্রেন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণাও হয়েছিলো।
তো দেরী কোন?? ডিসিশন ফাইনাল....
যাচ্ছি একলা সিমলা....
দিল্লীতে সে নেমে গেল। আমি টিটির সাথে কথা বলে দিল্লী টু কালকা নতুন করে টিকিট করে নিলাম। সিটও চেন্জ হলো। আরো প্রায় ৫ ঘন্টার জার্নি দিল্লী থেকে....
সকাল থেকে শুধু রুটি আর কলা খেয়েছিলাম। তাও সেই হাওড়া থেকে নেয়া তা। দুপুরে খাই নি কেননা প্লান ছিলো দিল্লী নেমে রাতে জম্পেস খাওয়া দিয়ে মানালীর বাস ধরবো। যেহেতু দিল্লী নামা হলো না, তাই খাওয়া ও আর হলো না।
এদিকে গভীর রাত। সাথে প্রচন্ড ঠান্ডা।
কেবিনে আমি একলা। ক্ষুধা বাড়া শুরু..
মনে করলাম যে কোন স্টেশনে থামলে কিছু কিনবো। কিন্তু আমার বগিটা একদম লাস্টের দিকে হওয়াতে দোকান কাছাকাছি পেলাম না। প্রতিটা স্টেশন আসে আর অপেক্ষা করি, এই বুঝি কেউ খাবার বিক্রি করতে উঠলো। কিন্তু না, গভীর রাত হওয়াতে একজন হকারকেও পেলাম না। ইতোমধ্যে এক স্টেশনের আউটে ট্রেন ১ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলো।
কী যে ক্ষুধার কষ্ট সেদিন পেয়েছিলাম তা লিখে প্রকাশ করতে পারবো না। শুধু মনে হচ্ছিল, কারোর থেকে চেয়ে কিছু কী খাব??? কিন্তু হিন্দী ভাষা না বোঝা আর নিজের আত্মসম্মান চিন্তা করে খাবার চেয়ে খাওয়াটা আর হয় নি।
এমনি ভাবে ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়েই ভোর ৪ টার পরিবর্তে ৫.৪০ এ পৌঁছালাম কালকা স্টেশনে। এবং নেমেই কিছু খাবার কিনে খেয়ে পেটকে শান্ত করলাম। এবং জীবনে প্রথমবার উপলব্ধি করলাম "অভুক্ত মানুষের কাকুতি"।।।
স্টেশনে তড়িঘড়ি করে টয় ট্রেনের টিকিট করলাম। কালকা টু সিমলা। ৬ টা ১৫ মিনিটে সে ট্রেন।
ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আশপাশের প্রকৃতি তার সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে শুরু করলো। জানালার সাইডে সিট পাওয়াতে বেশ সুবিধাই হলো।
এটা মূলত বৃটিশদের তৈরি করা রেল পথ। বৃটিশরা সিমলাকে বানিয়েছিলো গরম কালের রাজধানী। তাই অতি যত্নে পাহাড় কেটে কোটে ৯৬ কিঃমিঃ দীর্ঘ এ পথ তারা তৈরি করেছিলো। ৮৬৪ টি ব্রিজ ও ১০৩ টি টানেল বা সুড়ঙ্গ পার হবেন আপনি এ পথটুকুতে. বোঝেন তাহলে কতটা এ্যাডভেন্ঞ্চারময়!!
সঙ্গের সাথীর অমন মত পাল্টানো কিংবা ক্ষুধার কষ্টের সে অনুভূতি সব বিলীন হয়ে গিয়েছিলো টয় ট্রেনে সিমলা যাওয়ার পথে।
সত্যি সুন্দর। অনেক সুন্দর সম্পূর্ণ পথটা....
সিমলা পৌঁছে খোঁজ নিলাম কী কী দেখার আছে এখানে। জানলাম যে, এখানে তেমন বরফ নেই এখন। শুধুমাত্র সাইট সিন করা যেতে পারে। তখন আর সময় নষ্ট না করে রাতের মানালী বাসের টিকিট করলাম।
আর সমগ্র দিনটাকে রাখলাম সিমলা শহর দেখার জন্য।
সিমলা বেশ গোছানো একটি শহর। হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। জাখু মন্দির, মল রোড এগুলো দেখলাম। শীতের পোষাক বেশ কম দাম। আর সিমলার সবচেয়ে সুন্দর পাহাড়ের গায়ে ছবির মত সাজানো বাড়িঘর। চোখ ফেরানো দায়। রাতের সিমলাও বেশ সুন্দর। মল রোডে দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের বিভিন্ন স্তরের আলো সমেত বাড়িঘর দর্শন এককথায় অসাধারণ।
রাতে শুরু হলো মানালীর পথে বাস জার্নি...
ভোর ৫ টায় যখন মানলীতে নামিয়ে দিলো বাস তখন তাপমাত্রা -৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
হিমহিম ঠান্ডায় বাসস্ট্যান্ডে আগুন পোহালাম স্হানীয় মানুষদের সাথে। একই সাথে গরম চা তো আছেই।
সত্যকথা বলতে, নতুন জায়গা বা নতুন পরিবেশ নিয়ে এখন আর ভয় করছে না। বরফের রাজ্যে বিচরণের এক আলাদা ভাললাগার স্বপ্ন আমায় মুগ্ধ করছে।।
এখানে একটা মজার কথা শেয়ার করি....জীবনে প্রথম বরফ সমেত পাহাড় দেখেছি "কমোডে বসে" হু, সত্যই।
ওয়াশরুমে ঢোকার সময় চারিপাশে অন্ধকারই ছিলো। ওয়াশরুমে বসে একটুপর ওপরের জানালার দিকে চোখ গেলে দেখি "সাদা বরফের পাহাড় সূর্যের আলোতে কেবল তার সৌন্দর্য সূধা প্রকাশ করতে শুরু করছে।।।
সকাল ৯ টার দিকে শেয়ারে ট্যাক্সি পেলাম। সিসু ভ্যালি নামক এক জায়গায় সে নিয়ে যাবে। যেখানে বরফ আছে। রোথাংপাস পথেই পড়বে বলে সে জানালো। এটাও জানলাম যে, সোলাং ভ্যালিতে এখন বরফ আসে নি।
তার ওপর ভরসা করে আরে দু'জনের সাথে চলে গেলাম বরফের রাজ্য " সিসু ভ্যালিতে"
যাওয়ার পথে কী যে সৌন্দর্য তা লিখে প্রকাশ করা পসিবল না। এককথায় অসাধারণ.....
সেখানে ৩/৪ ঘন্টা বিচারণ শেষে দুপুরেই মানালী শহরে ফিরে আসি এবং রাতে দিল্লীর বাসের টিকিট করি। বাকি সময়টুকু মানালী শহরে মল রোডে এখানে ওখানে ঘুরাঘুরি করে কাটিয়ে দি।
এবার খরচের হিসাব-
কলকাতা টু কালকা ট্রেন (নন এসি স্লিপার)- ৯২৫+২০০ = ১১২৫ রূপী
কালকা টু সিমলা টয় ট্রেন- ৫০ রূপী (সাধারণ সিট)
(এখানে ১ম শ্রেণী এসি টিকিট ও আছে, ভাড়া ৫৪০ রূপী)
সিমলায় দিনব্যপী ঘুরাঘুরি ও খাওয়া- ২০০ রূপী
সিমলা টু মানালী - ৬০০ রূপী
মানালী টু সিসু ভ্যালী ( বরফের রাজ্য)- ৫০০ রূপী (শেয়ার ট্যাক্সি)
শীতের ভাড়া করা পোষাক- ৩৫০ রূপী (যা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, বরফের জন্য অমনটা নিলেও তা আসলে লাগে না)
মানালী সারাদিন খাওয়া- ২০০ রূপী
মানালী টু দিল্লী বাস- ১০৫০ রূপী (ভলভো বাস)
মোট- ৪০৭৫ রূপীতে কলকাতা টু সিমলা টু মানালী টু দিল্লী কমপ্লিটেড।