শ্রীলঙ্কায় রোড ট্রিপিং
শ্রীলংকা (আদি নাম সিলন) ভ্রমণ জগতে ইদানিং খুব ট্রেন্ডি ডেসটিনেশন। বিশেষ করে ইউরোপিয়ানদের কাছে এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ডেসটিনেশন এটি।
এই এপ্রিলের জঙ্গী হামলার দেড় মাস পর আমরা শ্রীলংকা যাই। এ জন্য বেশির ভাগ জায়গা বেশ নিরিবিলি পাই। হামলার পর দেশটিতে ট্যুরিজমে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে তিন দিন ঘুরে যতটুকু বুঝেছি তাতে ঘুড়ে দাঁড়াতে সময় লাগবে না দেশটির।
ট্যুরিজমের জন্য অবকাঠামো যেভাবে তৈরি করে রেখেছে ওখানে তাতে আগামী বছর আসতে না আসতেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কথা।
পিনাওয়ালা-পিদুরাঙ্গালা (১ম দিন)
আমরা মালদ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কা যাই। প্রথম রাতটা কলম্বোতে থাকি। সময় না থাকায় কলম্বো ঘোরা হয় নি। পরদিন সকালে উঠেই যাত্রা শুরু করি মাতালে শহরের সিগিরিয়ার উদ্দেশ্যে। কলম্ব থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার পথ। আমরা যাওয়ার পথে পিনাওয়ালা elephant orphanage জায়গাটা দেখার জন্য থামি।
Orphanage টা সরকারি, এবং সেখানে ঢোকার জন্য ১০০০ রুপি করে দিতে হয় জনপ্রতি। এ যেন এক জলসাঘর হাতিদের জন্য। এক পাল হাতি জলে আর পাথুড়ে ডাঙ্গায় নানা রকম অদ্ভুত কর্মকান্ডে ব্যাস্ত থাকে। হাতির নাচ পর্যন্ত দেখা হয়ে গেছে আমাদের। হাতিতে চড়া বা ওদের খাওয়াতে চাইলে আলাদা খরচ লাগে। এখানে আবার শ্রীলংকার বিখ্যাত হাতির গোবরে তৈরি কাগজের কয়েকটা দোকান আছে। নোটবুক থেকে শুরু করে কার্ড, ক্যালেন্ডার অনেককিছু পাওয়া যায় যা সব ওই গোবর দিয়ে তৈরি।
সিগিরিয়া পৌঁছতে আমাদের বিকেল হয়ে যায়। এদিন আমরা সিগিরিয়া রকের বিপরিতে অবস্থিত পিদুরাঙ্গালা রক ভ্রমনে যাই। পিদুরাঙ্গাল রকে সূর্যাস্ত দেখা অনেক জনপ্রিয় লোকালদের মধ্যেও। এখানে একটা বুদ্ধ মন্দির আছে হাজার বছরের পুরনো। দেড় ঘন্টার মত পাথুরে পাহাড় বেয়ে উঠে (২০০ মিটার) আমরা এর চূড়ায় পৌঁছাই। ওঠার পথে পাথড় কেটে সিঁড়ি করা আছে বেশিরভাগ জুড়ে।
উপরে গিয়ে প্রথম ঢাল থেকে সিগিরিয়া রকের চমৎকার একটা দৃশ্য পাওয়া যায়। সেখানে কিছুক্ষন বসে চলে যাই একদম উপরের ঢালে। বাতাসে উড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয় এখানে। চূড়া থেকে যতদূর চোখ যায় শুধু বন চোখে পড়বে মাটিতে। আর সীমানা ঘেঁষে কয়েকটা পাহাড়ের সারি। ঠিক মাঝখানে এই দুই পাথুড়ে পাহাড় – সিগিরিয়া আর পিদুরাঙ্গালা।
সিগিরিয়ার সূর্যাস্ত আসলেই দেখার মত একটা জিনিস। চারদিক জুড়ে এমন নিরবিচ্ছিন্ন আকাশে সূর্যাস্তের উৎসব আবেগে ভারী করে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। এখান থেকে চলে যাই হোটেলে।
সিগিরিয়া-রাম্বোডা ঝর্না (২য় দিন)
পরদিন ভোরবেলা হোটেল থেকে বেরিয়ে সিগিরিয়া রক ফোর্ট্রেস দেখতে চলে আসি। এন্ট্রি ফি দিয়ে ঢুকে প্রথমে মিউজিয়াম দেখি। মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে সিগিরিয়া পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাই সিগিরিয়া রক ফোর্ট্রেস। এখানকার ইতিহাস মতে ৪০০ শতকের শেষের দিকে রাজা কাশ্যাপা তার বাবাকে হত্যা করে সিগিরিয়া রকে এসে নিজের প্রাসাদ বানায়।
আর এখানকার বুদ্ধ মন্দিরকে পাশের পিদুরাঙ্গালা রকে স্থানন্তর করে। পাথর আর লোহার সিঁড়ি ভেঙ্গে এর চূড়ায় যেতে ৪০-৫০ মিনিটের মত লাগে। মাঝ পথে পাথরে খোদাই করে সিংহ দরজা বানানো আছে। আরো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে এর বিভিন্ন জায়গায়। অনেক রোদ থাকায় বেশিক্ষন চূড়ায় থাকা হয় নি। সিগিরিয়া থেকে নেমে আমরা নুয়ারা এলায়ার পথে রওয়ানা করি। যাওয়ার পথে শ্রী মুথুমারিয়াম্মান মন্দির আর রাম্বোডা ঝর্না দেখে যাই। রাম্বোডা ঝর্নায় যেতে হয় পাহাড়ের ঢালে একটা রেস্টুরেন্টের ভেতর দিয়ে। ঝর্নার
একদম নিচে যাওয়ার আগের সিঁড়িটা প্রবেশ নিষধ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বন্ধ করা ছিলো। তাও ঝর্নাপ্রেমী হিসেবে ওই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঝর্নাটাকে কাছ থেকে কিছুক্ষন দেখে আসি। সাড়ে তিনশ ফিট উঁচু এই ঝর্না। এখান থেকে একটা টি এস্টেট ঘুরতে চলে যাই।
চা যে কত ধরনের আর ফ্লেভারের হতে পারে তা গুনে শেষ করা যাবে না। নুয়ারা এলায়ার হোটেলে পৌঁছতে আমাদের রাত ৯টা বেজে যায়। এটা একটা পাহাড়ি এলাকা, তাই আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। পাতলা জ্যাকেট ছাড়া চলাফেরা করা মুশকিল।
লাভার’স লীপ-এডাম’স পিক (৩য় দিন)
ভ্রমনের শেষের দিন খুব টাইট সিডিউল ছিলো আমাদের। নুয়ারা এলায়ার হোটেল থেকে বের হয়ে প্রথমে যাই লাভার’স লীপ ঝর্নাটা দেখতে। এটা দেখার জন্য ৩০-৪০ মিনিট ট্রেকিং করতে হয়। এই ঝর্নায় একজন রাজা আর তার আদিবাসী প্রেমিকা আত্মহত্যা করে বলে নামটা এমন রাখা হয়। সেখান থেকে এডাম’স পিকে যাওয়ার পথে সেন্ট ক্লেয়ার ঝর্না ও মহিনী ঝর্না দেখে যাই।
এডাম’স পিকে যাওয়ার নালাথান্নিয়া ট্রেইলের শুরূতে গিয়ে পৌঁছাই আমরা সকাল ১১টার দিকে। আগে থেকে গাইড ঠিক করা ছিল। তাকে সাথে নিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করি। ৫৫০০ সিঁড়ি বেয়ে চূড়ায় যেতে হয়। চূড়ায় আছে আদম (আ) পায়ের ছাপ। যা আবার বৌদ্ধদের কাছে বুদ্ধের পায়ের ছাপ ও হিন্দুদের কাছে শীবের পায়ের ছাপ হিসেবে পরিচিত। পায়ের ছাপটা সচক্ষে দেখতে হলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে আসতে হয়।
তখন আবার অনেক ভীড় থাকে তীর্থযাত্রার কারণে। অন্য সময়ে বন্ধ করে রাখা হয়ে ঘড়টা। আমরা বৃষ্টির মধ্যে যাওয়ায় ট্রেইলের এডভেঞ্চার বেড়ে যায় বহূগুনে। কয়েক পশলা বৃষ্টি আর মেঘেদের ধাক্কা খেতে খেতে উপরে গিয়ে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর বাইরে কোথায় চলে এসেছি। পুরো ট্রেইলে জুড়ে বেশ কিছু মন্দির আর অনেকগুলো ঝর্না চোখে পরে।
খরচ এবং আনুসাঙ্গিক তথ্য
শ্রীলংকা ঠিক ভিসা ফ্রি নয় বাংলাদেশের জন্য। তবে খুব সহজে অনলাইনে ২০ ডলারের মত দিয়ে একটা ই-টোকেন নেয়া যায়। প্লেন ভাড়াটা একটু বেশি। সময় ভেদে জন প্রতি রাউন্ড ট্রিপ বিমান ভাড়া ৩৫-৪০ হাজার পড়বে। খরচ কমাতে চাইলে ব্যাংকক হয়ে যাওয়া যায় তাতে প্রায় ৮ ঘন্টার মত সময় লাগে।
এইভাবে গেলে খরচ ৩০ হাজারের কিছু বেশি পরে। ৪০-৬০ ডলারের মধ্যে ভালো হোটেল পাওয়া যাবে সব জায়গায়। খাওয়া দাওয়া, যাতায়াত সবকিছুর খরচ অনেক কম। শ্রীলংকা ভ্রমনের জনপ্রিয় মাধ্যম হল রেন্টাল কার। সেটা ওখানে গিয়েও ঠিক করতে পারেন। তবে আমার মতে নিজেরা আগে কোথায় কোথায় যাবেন এটা ঠিক করে কোন এজেন্সির মাধ্যমে বুকিং এর কাজগুলো করিয়ে নিতে পারেন। কারণ, প্রথমত শ্রীলংকাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্ব অনেক। তাই ওখানে গিয়ে নিজেরা ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করতে গেলে অযথা অনেক সময় নষ্ট হবে। দ্বিতীয়ত যে গাড়ি ভাড়া করবেন তার ড্রাইভারই আপনার ট্যুর গাইড। এই লোকের সাথে টুরের কয়দিন আপনাকে থাকতে হবে। তাই কোন এজেন্সির মাধ্যমে গেলে আস্থা বা বিশ্বস্ততার প্রশ্নে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকা যায়। এ ছাড়া ব্যাক প্যাকাররা কার না নিয়ে বাসে করেও ভ্রমন করে শ্রীলংকা।